মিয়ানমারে যুদ্ধ: স্থল সীমান্তের পাশাপাশি নৌপথেও নিরাপত্তা জোরদার

বিশেষ প্রতিবেদক :

মিয়ানমারের অভ্যন্তরে দেশটির সেনাবাহিনী ও সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর তুমুল লড়াইয়ের মধ্যে সীমান্তে স্থলপথের পাশাপাশি নৌপথেও নিরাপত্তা জোরদার করেছে বাংলাদেশ।

ওপারের সংঘাতময় পরিস্থিতিতে টেকনাফ সীমান্তের নাফ নদী ও উপকূলীয় অংশে নিরাপত্তায় টহল জোরদার করার কথা বলেছে উপকূল রক্ষী বাহিনী-কোস্ট গার্ড।

টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিনগামী পর্যটকবাহী জাহাজগুলোকেও কোস্ট গার্ড নিরাপত্তা দিচ্ছে। তবে এ ‘যুদ্ধ পরিস্থিতিতে’ বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে নৌপথে বাণিজ্য প্রায় স্থবির হয়ে গেছে।

রাখাইনে সেনা ও বিদ্রোহীদের মধ্যে লড়াইয়ের প্রভাব পড়ছে সীমান্তের এপারের জনগোষ্ঠীর মধ্যেও। শনিবার সংঘর্ষের খবরের মধ্যে কক্সবাজারের টেকনাফের হোয়াইক্যংর একটি বাড়িতে একটি গুলি এসে পড়লে এলাকাবাসীর মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়।

গোলাগুলির ঘটনায় আতঙ্কে সোমবার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম এলাকায় কয়েকটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘ছুটি’ দেওয়া হয়। তবে মঙ্গলবার স্কুলগুলো ফের খুলেছে।

এ অবস্থার মধ্যে মঙ্গলবার রাতে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার সীমান্তবর্তী ঘুমধুম ইউনিয়নের তেঁতইয়ারছড়ায় এসে তিনটি মর্টার শেল পড়ে। এতে ওই এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

স্থল সীমান্তে যখন এই অবস্থা তখন মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের নাফ নদী দিয়ে সীমান্তে কড়া নজর রেখেছে উপকূলীয় এলাকায় নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করা কোস্ট গার্ড।

কোস্ট গার্ডের টেকনাফ জোনের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কমান্ডার লুৎফুল লাহিল মাজিদ বৃহস্পতিবার রাতে বলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নাফ এরিয়াতে হাইস্পিড বোট, মেটাল শার্ক বোট, জাহাজ, বিভিন্ন সরঞ্জামসহ কোস্ট গার্ড সদস্যরা টহল দিচ্ছেন।

টানা ২৪ ঘণ্টা টহল চলার তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ, শাহ পরীর দ্বীপসহ বিভিন্ন স্টেশনের মাধ্যমে নজরদারি করে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।

শীত মৌসুমে পর্যটকদের আকর্ষণের জায়গা কক্সবাজার ও টেকনাফের সেন্ট মার্টিন দ্বীপ। প্রতি বছরের মত এবারও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা ভিড় করছেন বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপে। প্রতিদিনই চলছে টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিন অভিমুখী জাহাজ। কোস্ট গার্ডের টহলের মধ্যেই পর্যটকবাহী জাহাজগুলো চলাচল করছে।

লুৎফুল লাহিল বলেন, “তাদের নিরাপত্তাও পুরোদমে দেওয়া হচ্ছে।”

এদিকে কোস্ট গার্ড এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, “মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশে মানবপাচার, চোরাচালান, মাদকদ্রব্যের অবৈধ অনুপ্রবেশসহ নতুনভাবে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ রোধে আমরা দৃঢ় অবস্থান নিয়েছি।

“সমুদ্রে সার্বক্ষণিক টহল জাহাজ মোতায়েনসহ দিনরাত অত্যাধুনিক নৌযান দিয়ে টহল পরিচালনা করা হচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন স্টেশনে টহলের জন্য অতিরিক্ত জনবলও নিয়োগ করা হয়েছে।”

নদী পথে বাণিজ্য প্রায় স্থবির

সীমান্তে সংঘাতময় পরিস্থিতিতে প্রায় আড়াই মাস ধরে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে নদী পথে বাণিজ্য প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে।

মিয়ানমার থেকে মাছ, আদা, পেঁয়াজ, সুপারি, কাঠ, বরই, আচার, শুটকিসহ নানা পণ্য আমদানি হয়ে থাকে। বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয় আলু, গেঞ্জি, প্লাস্টিক ও অ্যালুমিনিয়াম জিনিসপত্র, গাজী ট্যাংক, পটেটো চিপস ইত্যাদি।

টেকনাফ স্থলবন্দর পরিচালনাকারী ইউনাইটেড ল্যান্ড পোর্ট লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) জসীম চৌধুরী রাতে বলেন, “মিয়ানমারের যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। পণ্য আনা-নেওয়া করা যাচ্ছে না। এখানকার ব্যবসা-বাণিজ্য মূলত নাফ নদী দিয়ে ছোট ছোট কাঠের নৌকায় পরিচালিত হয়।

  • “আড়াই মাসে ২৫ থেকে ৩০টি নৌকা এসেছে। অথচ আগে প্রতি মাসে দেড়শ থেকে ২০০ নৌকা চলাচল করত। এখন তো যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে অনেকদিন ধরেই বন্ধ।”

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবরের শেষ দিক থেকে মিয়ানমারের তিনটি জাতিগত বিদ্রোহী বাহিনী একজোট হয়ে জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে সমন্বিত আক্রমণ শুরু করে। বাহিনীগুলো হল- তা’আং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি-টিএনএলএ, আরাকান আর্মি-এএ এবং মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স আর্মি-এমএনডিএএ।

তারা শান, রাখাইন, চীন ও কেয়াহ রাজ্যে লড়াই চালাচ্ছে। বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ও সেনাপোস্ট দখল করে ইতোমধ্যে তারা সাফল্য দেখিয়েছে।

আরাকান আর্মি (এএ) এই জোটের অন্যতম অংশ। মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য রাখাইনের সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠীর একটি সশস্ত্র বাহিনী এটি। তারা রাখাইনের বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে লড়াই করছে।

সার্বিক পরিস্থিতি জানতে সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিবির টেকনাফের কর্মকর্তাদের মোবাইলে ফোন করা হলেও তারা তা ধরেননি।

তবে সপ্তাহের শুরুতে দেওয়া এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়, লাগাতার সংঘর্ষের মধ্যে ‘সর্বোচ্চ সতর্ক’ থাকার নির্দেশ দিয়েছে বিজিবি। এতে বলা হয়, “সম্প্রতি পুরো মিয়ানমারে সংঘাতময় পরিস্থিতি চলছে। যার প্রভাব বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যেও এসে পড়েছে। প্রতিনিয়ত সেখানকার অস্থিতিশীল অবস্থা ও সংঘাতময় পরিস্থিতির খবর পাওয়া যাচ্ছে।”

২০২২ সালের অগাস্টের শেষ ও সেপ্টেম্বরের শুরুতে মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান ও ফাইটিং হেলিকপ্টার থেকে বাংলাদেশের সীমানার ভেতর গোলাবর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল। অনেক মানুষ আতঙ্কে সীমান্ত ছেড়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিয়েছিল। তখন দেশটির রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে এর প্রতিবাদ, নিন্দা ও উদ্বেগের কথা জানিয়েছিল ঢাকা।